"ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে" — বাংলা গান সম্পর্কে প্রবন্ধ

"ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে" গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার রচিত একটি আধুনিক বাংলা গান। এই গানটি মূলতঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই গানটির সুরকারও ছিলেন। "ও নদীরে" গানটি দাদরা তালে পরিবেশিত।

১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মৃণাল সেন পরিচালিত "নীল আকাশের নীচে" চলচ্চিত্রে এই গান প্রথম প্রকাশ পায়। এই চলচ্চিত্রের অন্য একটি গান "নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী"–ও অত্যন্ত জনপ্রিয়। এরপর ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয়–মার্কিন চলচ্চিত্র "সিদ্ধার্থ"–এও এই গান শুনতে পাওয়া যায়। এই ইংরেজি চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন কনরাড রুকস, এবং হেরম্যান হেস রচিত "সিদ্ধার্থ" বইটির ওপর ভিত্তি করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় "সিদ্ধার্থ" চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
"আনন্দধারা" নামক বইতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই চলচ্চিত্রে কাজের অভিজ্ঞতা এবং কীভাবে "ও নদীরে" একটি বাংলা গান একটি ইংরেজি চলচ্চিত্রে অন্তর্গত হলো, সে সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে একটি নতুন ছবিতে কাজ করার সুযোগ আসে। ইংরেজি ভাষায় ছবি। পরিচালক মার্কিন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব কনরাড রুকস। কনরাড রুকসের আগের চলচ্চিত্র "চাপাকোয়া"–তে সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর। কনরাড তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রের জন্য মুম্বাইয়ের (তখন "বোম্বাই") বিভিন্ন সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে যোগাযোগ করছিলেন। ইতোমধ্যে, সিমি গ্রেওয়াল এই চলচ্চিত্রের মুখ্য নারী চরিত্র (নায়িকা) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সিমি গ্রেওয়াল ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের বিশেষ অনুরাগী। যখন কনরাড সিমিকে জিজ্ঞেস করেন যে "সিদ্ধার্থ" চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাকে নেওয়া যেতে পারে, সিমি ওনাকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এবং সুর করা বেশ কয়েকটি গান শোনান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানগুলি কনরাডকে অভিভূত করে, এবং কনরাড স্থির করেন যে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নেবেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে লন্ডনে এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত এবং আবহ রেকর্ডিং হয়। রেকর্ডিংয়ের কাজ যখন শুরু হয়েছে একদিন চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা উল্লেখ করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বললেন, "এইরকম পরিস্থিতিতে আপনি কোনও ভারতীয় গান শোনাতে পারেন?" হেমন্ত তাঁকে "ও নদীরে" গানটি শোনালেন। গানের ভাবার্থ ওই দৃশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। হেমন্ত ওনাকে গানের অর্থও বুঝিয়ে বলে দিলেন। গান শুনে, আর গানের অর্থ জেনে কনরাড রুকস খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠলেন। বললেন, "আমি এই গানটিই ব্যবহার করবো।" হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটু ইতস্ততঃ করে বললেন "ইংরেজি ছায়াছবিতে বাংলা গান?" কনরাডের তাৎক্ষণিক এবং নিষ্কপট উত্তর "কেন, আমরা ইংরেজি চলচ্চিত্রে ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, পোলিশ গান ব্যবহার করি না? তাহলে, বাংলা গানেরই বা অসুবিধা কোথায়?" এইভাবে "সিদ্ধার্থ" ইংরেজি চলচ্চিত্রে "ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে" গানটি অন্তর্গত হল।

এই গানটিতে নদীকে এক জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে কল্পনা (personification) করা হয়েছে। একজন ব্যক্তির সাথে যেইরূপ কথোপকথন হয়, সেইরূপ এই গানে নদীর সাথে কথোপকথন চিত্রিত ও বর্ণিত হয়েছে। আবার, সঙ্গীতচর্চা বিশেষজ্ঞদের মতে নদীর বহমানতা মানবজীবনের চলমানতাকে চিত্রিত করে। তাই, এই গানে নদী ইঙ্গিতপূর্ণভাবে মানবজীবনেরই অন্য এক রূপ। "কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ" — এই প্রশ্নগুলি মানুষ এবং মানবজীবনের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য।

আবার এইটিও দেখা যেতে পারে যে, গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দুইজনেই বাংলার মানুষ। নদীমাতৃক বাংলা। একদিকে গঙ্গা–পদ্মা, অন্যদিকে রয়েছে দামোদরের বন্যা। নদীর সাথে অন্তরঙ্গ বাংলার জীবন। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং ধর্মীয় অন্তরঙ্গতা। রয়েছে নদীর ভাঙা–গড়া, এবং একই সাথে এইসকল মানুষের জীবনেও ভাঙা–গড়া। এই গানে এইসকল বক্তব্যও প্রশ্নসূচকভাবে স্থান পেয়েছে।

গানের কথা

"ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে" এই গানটির কথা (লিরিক্স) এইরকম—
ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে (২)
বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ
ও নদীরে...
 
তোমার কোনো বাঁধন নাই তুমি ঘরছাড়া কি তাই (২)
এই আছো ভাঁটায় আবার এই তো দেখি জোয়ারে।

একূল ভেঙে ওকূল তুমি গড়ো
যার একূল ওকুল দুকূল গেল তার লাগি কী করো? (২, স্তবক)

আমায় ভাবছো মিছে পরে তোমার নাই কি অবসর (২)
সুখ–দুঃখের কথা কিছু কইলে না হয় আমারে।

(ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে)...

দেখাশোনা

"ও নদীরে একটি কথা শোনাই শুধু তোমারে" এই গানটির একটি ভিডিও আপনি ইউটিউবে দেখতে পারেন। অথবা নীচেও দেখতে পারেন। এই ছাড়া আপনি ইউটিউবের সারেগামা চ্যানেলেও শুনতে পারেন। 

"ও নদীরে" গানের ভিডিও। ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত "নীল আকাশের নীচে" চলচ্চিত্র থেকে।

আরও পড়ুন

আপনি এই প্রবন্ধটিও পড়তে পারেন—

মন্তব্যসমূহ