"আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা" — বাংলা গান সম্পর্কে প্রবন্ধ

"আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা" (১৯৬১) হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা গান। এই গানটির গীতিকার এবং সুরকার সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরী মূলতঃ একজন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রখ্যাত হলেও, তিনি গান এবং কবিতা লিখেছিলেন। "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম" এইরকমই একটি গান। এই গানটি "দাদরা" তালে সুরবদ্ধ।

সলিল চৌধুরী
সলিল চৌধুরী
সলিল চৌধুরীর (১৯২৫–১৯৯৫) জীবনের এবং সঙ্গীতজীবনের একটি বড় অংশ গণসঙ্গীত আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। গণসঙ্গীত আর ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (Indian People's Theatre Association অথবা IPTA) সাথে কাজ করার সময় সলিল চৌধুরী এমন অনেক গানে কাজ করেন যেইসকল গানে সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রাম, জীবনের পাওয়া, না–পাওয়া, আশা–নিরাশা, সুখ–দুঃখ মূল প্রতিপাদ্য হয়ে প্রকাশিত এবং পরিবেশিত হয়। এইরূপ কিছু গানের উদাহরণ: "ঘুম ভাঙ্গার গান" ("ঢেউ উঠছে কারা উঠছে"), "হেই সামালো ধান হো", "ভাঙো ভাঙো ভাঙো কারা", "পথে এবার নামো সাথী" ইত্যাদি।

সলিল চৌধুরীর লেখা, এবং সুর করা এই গানটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬১ সালে (রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বছরে)। এই গানটি কীভাবে তৈরী হল, এর ইতিহাস খুঁজে দেখতে হলে মূলতঃ দুইরকম চিত্র ভেসে ওঠে। দুই চিত্রে সামঞ্জস্য অধিকাংশ, তবে কিঞ্চিৎ অসামঞ্জস্যও রয়েছে। 

এক, সময়টা ১৯৬০ সাল নাগাদ। ঋত্বিক ঘটক তাঁর নতুন চলচ্চিত্র "কোমল গান্ধার"–এর কাজ শুরু করেছেন। তা', ঋত্বিক ঘটক সলিল চৌধুরীকে বললেন একটি গান তৈরি করে দেওয়ার জন্য যেই গানে "প্রেম" এবং "বিদ্রোহ" দুইই থাকবে। তো ঋত্বিক ঘটকের অনুরোধে সলিল যেই গানটি লিখলেন সেইটিই হলো "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা"। যদিও এই গান বিভিন্ন কারণে সেইসময় চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়নি।

দুই, সময়টা একই সময়, ১৯৬০ সাল নাগাদ। এই ঘটনা শুনিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক নিজেই। "চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু" বইতে এই সম্পর্কে তথ্য পাবেন। সলিল চৌধুরীর সাথে ঋত্বিক ঘটকের বেশ অনেকদিন পর দেখা হলো। সলিল চৌধুরী বললেন যে তিনি একটি নতুন গান তৈরি করেছেন, এই বলে তিনি ঋত্বিক ঘটককে "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম" গানটির প্রাথমিক খসড়া শোনালেন। গান শুনেই ঋত্বিক ঘটক লাফিয়ে উঠলেন। বললেন "আরে এ' তো আমার গান। এই গান আমিই ব্যবহার করবো।"

দুইটি বর্ণনাই প্রায় একই রকম। যদিও এই গানটি চলচ্চিত্রে প্রকাশ পায়নি, ঋত্বিক ঘটক যে এই গানের নির্মাণের ইতিহাসে রয়েছেন, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

তবে, এইটি কার জীবনের গান? কার জীবনের কথা প্রকাশ পায় এই গানে? একদিকে ঋত্বিক ঘটক বলছেন এইটি তাঁর গান। আবার গানের গীতিকার, সুরকার সলিল চৌধুরীও বলছেন "গানটাতে নিজের জীবনের ছোঁয়াই একটু রাখতে চেয়েছি।"  আবার দেখুন, গানের গায়ক (কণ্ঠশিল্পী) হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও এই গানের সাথে স্পষ্টতঃ নিজের জীবনের একাত্মতা দেখতে পেয়েছিলেন। 

তবে, এইটি কার গান? এক কথায় যদি উত্তর চান, এর উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে বোধ করি, এই গান সেই সব মানুষের গান যারা নির্ভীক, নিঃস্বার্থ, বেপরোয়া, এবং একই সাথে অত্যন্ত সৎ। অত এব, মাননীয়/মাননীয়া পাঠক/পাঠিকা, হয়তো বা এইটি আপনি আপনার গান বলেও মনে করতে পারেন। এবং, সেইটি বোধ করি, ঠিকই মনে করেছেন। নয় কি?

গানের কথা

"আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা" গানটির কথা এইরূপ—
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।  (২)
আমি কাঁদলাম বহু হাসলাম, এই জীবন জোয়ারে ভাসলাম
আমি বন্যার কাছে ঘূর্ণির কাছে রাখলাম নিশানা।
 
কখন জানিনা সে তুমি আমার জীবনে এসে
যেন সঘন শ্রাবণে প্লাবনে দু'কূলে ভেসে শুধু হেসে ভালোবেসে
যত যতনে সাজানো স্বপ্ন হলো স্বপনে নিমিষে ভগ্ন
আমি দুর্বার স্রোতে ভাসলাম করি অজানায় নিশানা
 
ওগো ঝরা পাতা যদি আবার কখনো ডাকো
সেই শ্যামল হারানো স্বপনো মনেতে রাখো
যদি ডাকো, যদি ডাকো।  (২)
 
আমি আবার কাঁদবো হাঁসবো
এই জীবন জোয়ারে ভাসবো
আমি বজ্রের কাছে মৃত্যুর মাঝে রেখে যাবো নিশানা
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।

দেখাশোনা

"আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা", এই গানটির একটি ভিডিও আপনি দেখতে পারেন ইউটিউবের সারেগামা চ্যানেলে। অথবা, আপনি এই গানটি নীচেও দেখতে পারেন।

আরও পড়ুন


মন্তব্যসমূহ