"কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা" (গাঁয়ের বধূ) — বাংলা গান সম্পর্কে প্রবন্ধ
"কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো" (১৯৪৯) হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি জনপ্রিয় বাংলা গান। এই গানটি "গাঁয়ের বধূ" অথবা "গাঁয়ের বধূর গান" শিরোনামেও পরিচিত। গানটির গীতিকার, এবং সুরকার সলিল চৌধুরী। এই গানটি "দাদরা" তালে সুরবদ্ধ"।
সলিল চৌধুরীর (১৯২৫–১৯৯৫) নিজের জীবনের এবং সঙ্গীতজীবনের একটি বড় অংশ গণসঙ্গীত আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। সলিল চৌধুরী (সুরকার/গীতিকার হিসেবে) হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (গায়ক হিসেবে) বেশ অনেক গানে একসাথে কাজ করেন, যার মধ্যে অনেক গান ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয় এবং কালজয়ী হয়ে ওঠে। "গাঁয়ের বধূ" এইরকমই একটি প্রথম দিককার গান।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (Indian People's Theatre Association অথবা IPTA) সাথে সংযুক্ত থেকে সলিল চৌধুরী এমন বহু গানে কাজ করেন যেইসকল গানে সাধারণ মানুষ, মানুষের জীবন, জীবনসংগ্রাম, জীবনের প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি, আশা–নিরাশা, সুখ–দুঃখ মূল প্রতিপাদ্য হয়ে প্রকাশিত এবং পরিবেশিত হয়।
সলিল চৌধুরীর লেখা এবং সুর করা এই গান একই সাথে সাধারণ মানুষের জীবন এবং তারই সাথে মন্বন্তরের ভয়াবহতা তুলে ধরে। এই গানের মূল চরিত্র এক গাঁয়ের সাধারণ বধূ। এই গানে মূলতঃ সেই গাঁয়ের বধূর কথা তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে তাঁর জীবনের আশা, স্বপ্ন, জীবনচর্চা বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে কীভাবে মন্বন্তর, শোষণ ইত্যাদি এই সরল–সাধারণ জীবনকে বিষাদময় তথা যন্ত্রনাময় করে তোলে তাও বর্ণিত হয়েছে। এই গানের আবহে ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ভয়াবহ যন্ত্রনা এবং বিষাদ চিত্রিত হয়েছে।
![]() |
| হেমন্ত মুখোপাধ্যায় |
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানটি শুনে চমৎকার লাগলো। তিনি সলিল চৌধুরীকে বললেন যে তিনি গানটি গাইতে চান। গানটি রেকর্ড হয়ে প্রকাশিত হলো। প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই তুমুল জনপ্রিয়তা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিজের ভাষায় "আশাতীত সাফল্য"।
আজ "কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা" গান প্রকাশের প্রায় ৭৫ বছর পরেও এই গানটি একই রকম জনপ্রিয়। বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে এই গানটি অবশ্যই একটি অন্যতম সেরা গান।
গানের কথা
"কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা" গানটির কথা (লিরিক্স) এইরকম—
রূপকথা নয় সে নয়, জীবনের মধুমাসের
কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালার শিশির ভেজা কাহিনী শোনাই শোনো।
একটুখানি শ্যামল ঘেরা কুটিরে তার স্বপ্ন শত শত
দেখা দিত ধানের শিষের ইসারাতে দিবা শেষে কিষাণ যখন আসতো ফিরে
ঘি মৌ মৌ আম কাঁঠালের পিড়ি দিতে বসতো তখন সবখানি মন উজাড় করে
দিত তারে কিষাণী সেই কাহিনী শোনাই শোনো।
শাস্ত জলে হাতছানিতে ডাকতো কাছে আদর করে সোহাগ ভরে
নীল শালুকের দোলন দিয়ে রং ফাগুনের বেশে
ঘুমপরী সে ঘুম পাড়াতো এসে কখন যাদু করে
ভোমরা যেত গুণগুণিয়ে ফোটা ফুলের পাশে
আকাশে বাতাসে সেথায় ছিল পাকা ধানের বাসে বাসে সবার নিমন্ত্রণ। (২)
সেখানে বারো মাসের তেরো পাবন, আষাঢ় শ্রাবণ
কি বৈশাখের গাঁয়ের বধূর শাঁখের ডাকে
শত পাখী বাঁধিয়া নাচে তা তা তা ধিয়া, নাচে তা তা তা ধিয়া নাচেরে
মায়ার কুটিরে নিলো সব লুটিরে মরুর রসনা এলো রে।
হায় সেই মায়া ঘেরা সন্ধ্যায়, ডেকে যেত কত নিশিগন্ধা
হায় সেই সুন্দরী কোথায় তোমার সেই মধুর জীবন মধুছন্দা,
হায় সেই সোনাভরা প্রান্তর, সোনালী স্বপন ভরা অন্তর
হায় সেই কিষাণ আর কিষাণীর জীবনের ব্যথার পাষাণ আমি বহি রে।
আজো যদি তুমি কোনো গাঁয়ে দেখো ভাঙা কুটিরের সারি
দেখাশোনা
আরও পড়ুন
- "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, সলিল চৌধুরীর লেখা এবং সুর করা গান
বহিঃসযোগ
- "গাঁয়ের বধূ" গানের সম্পর্কে প্রতিবেদন (আনন্দবাজার পত্রিকা)

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন